বোটানিক্যাল গার্ডেন মিরপুর ‘ছায়া সুনিবিড় পাখির কলকাকলি মুখর এক নিভৃত আঙ্গিনা। সকাল, দুপুর, রাত্রি যেখানে ফুলের মৌমৌ সুবাস ছড়িয়ে যায় বাউল বাতাসে। রাজধানীবাসীর স্বস্তির এক টুকরো সবুজ বাতায়ন। কয়েক বছর আগে বোটানিক্যাল গার্ডেন নিয়ে অনেক অভিযোগ ছিল। বর্তমান সময়ে এসবের অনেক পরিবর্তন এসেছ। উদ্যানটির আধুনিকায়নে বর্তমান সরকার মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন দিয়েছে। উন্নয়ন কর্মকান্ড চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন এসব কর্মকান্ডের সাথে জড়িত কর্মকর্তাগণ।
জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান বা বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম বাংলাদেশে উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত। কেন্দ্রটি ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন নামেও পরিচিত। উদ্যানটি ঢাকার মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানার পাশে অবস্থিত। ১৯৬১ সালে প্রায় ২০৮ একর (৮৪ হেক্টর) জায়গা জুড়ে উদ্যানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকার আরেকটি উদ্যান বলধা গার্ডেন প্রশাসনিক দিক দিয়ে এই উদ্যানেরই অংশ। জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উদ্ভিদ উদ্যান। প্রতিবছর প্রায় ১৫ লক্ষ দর্শনার্থী উদ্যানটিতে বেড়াতে আসতো কিন্তু কর্তমানে সেটি কমে এসে ৮ লাখে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান রিপুরের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কথা হয় গার্ডেনের জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কর্মকর্তা সোহেলা সরকারের সাথে। তিনি বলেন, উদ্যানের পরিবেশ ভালো রাখার জন্য সর্বদাই সজাগ দৃষ্টি রাখছেন তারা। দর্শনার্থীদের নিরাপদ বিচরণসহ তাদের নিরাপত্তা রক্ষায় সার্বক্ষণিক টহল দিয়ে যাচ্ছে উদ্যানের নিজস্ব আনসার বাহিনী। স্কুল, কলেজের ছাত্রদের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বাগানে প্রবেশ ঠেকানোসহ অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি আমরা। এছাড়াও অশোভন অচরণসহ অসামাজিক কর্মকান্ড রোধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও গবেষক, শিক্ষার্থী এবং জীববৈচিত্র ও পরিবেশ রক্ষায় কাজ করেন যেসব মানুষেরা তাদেরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়া হয় এখান থেকে।
জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের পরিচালক মাহমুদা রোকসানা সুলতানা বলেন, তিনি আরও বলেন, আমরা টিউলিপের কিছু জাত নিয়ে কাজ করছি। সাদা, কালো , লালসহ ৫ প্রকারের টিউলিপ আমরা নিজেদের জলবায়ুর উপযোগী হিসেবে যুক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। টিউলিপের জাত উন্নয়নে সফলতা এসেছে বেশকিছু।
আগের হিসেব অনুযায়ী জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ১১৭টি গোত্রভুক্ত ৯৫২ প্রজাতির গাছপালার হিসেব পাওয়া গেলেও বর্তমান হিসেবে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৪২ প্রজাতিতে। এর মধ্যে ২৫৬টি প্রজাতির ৩৫ হাজার বৃক্ষ, ৩১০ প্রজাতির ১০ হাজার গুল্ম, ৩৭৮ প্রজাতির ১২ হাজার বিরুৎ ও লতা জাতীয় উদ্ভিদ। ২০৮ একর উদ্যানটি মোট ৫৭টি সেকশনে বিভক্ত। এতে আছে বিভিন্ন আকারের মোট ৭টি জলাশয়। জলাশয়গুলোর মোট আয়তন ১১ একর। একটি জলাশয়ের পাশে রয়েছে কৃত্রিম জলপ্রপাত ও ডেক। আরও রয়েছে শাপলা পুকুর ও গোলাকৃতির পদ্মপুকুর।
১৯৮০-৮১ সালে নির্মাণ করা হয় উদ্যানের দেবদারু-ইউক্যালিপটাস বাগান। ইউক্যালিপটাসগুলো অস্ট্রেলিয়া থেকে সংগ্রহ করা। ১৬ প্রজাতির ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি রয়েছে এখানে। বাঁশবাগানে রয়েছে প্রায় ২২ প্রজাতির বাঁশ। গর্জন বাগানের উত্তর পাশে সৃষ্টি করা হয়েছে ভেষজ উদ্ভিদের বাগান। এই বাগানে রয়েছে কালমেঘ, তুলসী, আতমোরা, শতমূলী, পুনর্নভা, থানকুনি, আদা, বোতল ব্রাশ, তেলাকুচা, কুমারি লতা, বাসক, বচসহ হরেক ভেষজ উদ্ভিদের সংগ্রহ।
গ্রিন হাউজ ও নেট হাউজ
উদ্যানের ক্যাকটাস গ্রিন হাউজে ৮০ প্রজাতির ক্যাক্টাস ও সাকুলেন্ট সংরক্ষিত রয়েছে। গ্রিন হাউজটি ১৯৯৪ সালে নির্মিত হয়। বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাসের মধ্যে রয়েছে ওল্ডম্যান, ফিসহুক ক্যাকটাস, ম্যামিলারিয়া, ক্ষেপালিয়া, মেলো ক্যাকটাস, গোল্ডেন ব্যারেল, সিরিয়াম হেক্সোজেনাস, র্যাট টেইল, আপাংসিয়া সিডাম, হাওয়ার্থিয়া, পিকটোরিয়া ইত্যাদি। বেশিরভাগ ক্যাকটাস মেক্সিকো থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। অর্কিড গ্রিন হাউজে দেশি-বিদেশি প্রায় ৮৫ প্রজাতির অর্কিড সংরক্ষিত রয়েছে। নেট হাউজে ছায়াতরু সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রায় ১০০ প্রজাতির ছায়াতরু রয়েছে এ হাউজে।
আন্তর্জাতিক উদ্ভিদ শাখা
উদ্ভিদ উদ্যানে বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ নিয়ে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক এলাকা নামে একটি শাখা সৃষ্টি করা হয়। এই শাখায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সিলভার ওক, জ্যাকারান্ডা ও ট্যাবে বুইয়া, জাপানের কর্পূর গাছ, মালয়েশিয়ার ওয়েল পাম, থাইল্যান্ডের রামবুটান।
নার্সারি
উদ্ভিদ উদ্যানের প্রায় ৫ একর জায়গা জুড়ে একটি নার্সারি রয়েছে। এ নার্সারিতে ফুল, ফল, লতা, গুল্ম ইত্যাদি উদ্ভিদের চারা চাষ করা হয়। সরকার নির্ধারিত মূল্যে এই নার্সারি থেকে চারা কেনা যায়।
অন্যান্য উদ্ভিদ সংগ্রহ
উদ্যানের অন্যসব সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে অশোক, বাওবাব, তসবিহ গাছ, ফার্ন কড়ই, তুন, কেশিয়া নড়ুসা, চেরি গাছ, মহুয়া, কৃষ্ণচূড়া, কামিনী, নাগেশ্বর, বহেড়া, শ্বেত চন্দন, উদয়পদ্ম, গিলরিসিভিয়া, কুম্ভি, আমলকী, জারবেরা, অ্যানথুরিয়াম, বিচিত্রা, ক্যামেলিয়া, পারুল, হেলকুনিয়া, হিজল, রক্ত কম্বল, সেগুন, মেহগনি, রাজকড়ই, আকাশমণি, অ্যামহাসটিয়া অ্যাভোকাডো, বেগুনি এলামান্ডা, থাইল্যান্ডের গন্ধরাজ, অর্জুন প্রভৃতি।
জানা গেছে, বিশাল এ উদ্যানে আগের মতো ভিড় জমে না। বিগত করোনার সময় থেকে দর্শনার্থীর সংখ্যা কমেছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা।
উদ্যানের কর্মীরা জানান, সকালের দিকে স্থানীয় বাসিন্দারা হাঁটাহাটির জন্য এলেও বিকালে বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা উদ্যান দেখতে আসেন। এসব দর্শনার্থীরা আসেন রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরে থেকে। ঢাকায় বেড়াতে আসা লোকজন সুযোগ সুবিধা মতো চলে আসেন উদ্যানে। নানা প্রজাতির গাছপালা আর সুন্দর সতেজ পরিবেশে ভ্রমণপিপাসা মিটায় তারা। তবে তাদের মধ্যে বেশ অসেচেতনতা রয়েছে বলে জানান গার্ডেন কর্তৃপক্ষ।
কথা হয় বাগানে ঘুরতে আসা স্বর্ণা সানজিদার সাথে, স্বামী ও মেয়ে নিয়ে বেড়াতে আসা স্বর্ণা বলেন, ‘জায়গাটা অনেক সুন্দর আর নিরিবিলি। এখানে অনেক নতুন প্রজাতির গাছপালা দেখতে পেলাম। চারিদিকে গোলাপ বাগানসহ মৌসুমী ফুলের ছড়াছড়ি। নাম না জানা ফুলের সৌরভ ছড়ানো। সত্যি খুবই ভালো লাগছে।’
উদ্যানে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন আনসার সদস্যরা। বিশাল এই উদ্যানের দেখাশুনা করার দায়িত্ব পালনে রয়েছে মাত্র ২২ জন আনসার সদস্য সংশ্লিষ্টরা মনে করেন বাগানের পরিবেশ সমুন্নত রাখতে এই সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার।
উদ্ভিদ উদ্যান
বোটানিক্যাল গার্ডেন মূলত জীবন্ত উদ্ভিদের একটি সংগ্রহ যা উদ্ভিদ গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পর্ক চিত্রিত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। আধুনিক সময়ে, বেশিরভাগ বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রাথমিকভাবে শোভাময় গাছপালা প্রদর্শনের সাথে সম্পর্কিত, যতটা সম্ভব প্রাকৃতিক সম্পর্কের উপর জোর দেয় এমন একটি পরিকল্পনায়। এইভাবে, দুটি ফাংশন মিশ্রিত হয়: চোখের আবেদন এবং শ্রেণীবিন্যাস ক্রম। যে সব গাছপালা একসময় ঔষধি মূল্যের এবং আদি বোটানিক্যাল গার্ডেনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেগুলি এখন প্রধানত ঐতিহাসিক আগ্রহের বিষয় এবং সমসাময়িক সংগ্রহে বিশেষভাবে উপস্থাপিত হয় না। একটি প্রদর্শন বাগান যা কাঠের গাছপালার (লতা-গুল্ম এবং গাছ) উপর মনোনিবেশ করা।
কালের সমাজ//এ.সং//র.ন
আপনার মতামত লিখুন :