ঢাকা রবিবার, ০৬ এপ্রিল, ২০২৫, ২৩ চৈত্র ১৪৩১
ড. আব্দুল্লাহেল বারী

জাহাজ নির্মাণ শিল্প জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোপান

সালাম মাহমুদ মার্চ ২৪, ২০২৫, ০৭:১৮ পিএম জাহাজ নির্মাণ শিল্প জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোপান

ড. আব্দুল্লাহেল বারী, বি.এ, বি.এস.সি ইঞ্জি:, পি.এইচ.ডি, সি. ইঞ্জি:এফ.আই.ই.বি, এফ.রিনা, কাউন্সিল মেম্বার, রিনা, ইউ. কে. রিনা, চেয়ারম্যান, আনন্দ শিপইয়ার্ড এন্ড স্লিপওয়েজ লিঃ, সভাপতি, এসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট অরিয়েন্টেড শিপ বিল্ডিং ইন্ড্রাষ্টিজ অব বাংলাদেশ, দেশের জাহাজ শিল্পের পথিকৃৎ বলা হয় তাকে। ১৯৮৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের মেঘনা ঘাটে গড়ে তোলেন আনন্দ শিপইয়ার্ড। ২০০৮ সালে স্টেলা মেরিস নামের জাহাজ ডেনমার্কে রফতানির মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে জাহাজ রফতানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত করেছেন। ব্রিটেনে জাহাজ শিল্পের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে সে জ্ঞান তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের জাহাজ শিল্পে। বুয়েট থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করে প্রথমে সরকারি চাকরি, পরে বুয়েটের শিক্ষকতা পেশা এবং সর্বশেষ একজন সফল ব্যবসায়ী হয়েছেন তিনি। সম্প্রতি হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে টেলিভিষশন রিপোর্টার্স ইউনিটি অব বাংলাদেশ (ট্রাব) কর্তৃক বেস্ট এন্টারপ্রেণার অব দ্যা ইয়ার অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন।

দৈনিক কালের সমাজ-এ দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি দীর্ঘ ব্যবসায়ী জীবনের গল্প বলেছেন। তার সাক্ষাৎকারের বিশেষ অংশ পাঠকদের জন্য তুলে হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সালাম মাহমুদ ।

দৈনিক কালের সমাজ : আপনি জাহাজ নির্মাণ শিল্পের প্রতি আগ্রহী হলেন কীভাবে?

আব্দুল্লাহেল বারী : কমোনওয়েল; বৃত্তি নিয়ে বিলেতে জাহাজ নির্মাণের উপর পি এইচ ডি করছিলাম। সুপারভাইজার বলতে গেলে কিছুটা উদ্বৃত্ত কাজ দিলেন জাহাজ নির্মাণে মানুষের ব্যবহার কমানো যায় কিভাবে? পড়ালেখা করে জানা গেল, অনেক গবেষণা তখন সম্প্রতি করা হয়েছে, কিছু কিছু উপায়ও দেয়া হয়েছে। পরিক্ষা করে দেখা গেল, সুপারিশকৃত পদ্ধতি ব্যবহারে নির্মাণ ব্যয় অথবা ওজন বেড়ে যায় অনেক।  অতএব গবেষোণা শুরু করলাম। দেখা গেল জাহাজ নির্মাণে human input কমানো যায় না। উপসংহার করলাম।জাহাজ নির্মাণে মানুষ কম লাগিয়ে লাভ নাই; ১৯৮০ সালের কথা। যেখানে অল্প খরচে দক্ষ পারদর্শী লোকবল মিলবে, জাহাজ নির্মাণ শিল্প সে এলাকায় গড়ে এবং যতদিন মানুষের খরচা কম থাকবে তত দিন এই শিল্প ঐ এলাকার প্রসার লাভ করবে। দেশে ফিরে BUET এ যোগদান করলাম বটে কিন্তু মাথায় ঐ চিন্তাটি রয়ে গেল।আমাদের দেশে মানুষের বেতন ভাতাদি অনেক অনেক কম, বাঙ্গালী সংঙ্কর জাতি, অতি বুদ্ধিমান। বাংলাদেশ পৃথিবীর সমস্ত জাহাজ বানাবে, কোন দেশেরই জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশের সঙ্গে পারার কথা নয়। ১৩০০ সালে বাঙ্গলা পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ জাহাজ নির্মাণকারী এলাকা ছিল।ইহাই আমার জাহাজ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহন করার কারণ।

দৈনিক কালের সমাজ : জাহাজ নির্মাণ শিল্পের যাত্রার গল্পটি একটু জানতে চাই। আব্দুল্লাহেল বারী : ১৯৮৩ সাল, আমি বিআইডাব্লিউটিসির প্রধান প্রকৌশলী (প্ল্যানিং এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং)। ১৯৮৫ সালের শুরুতে আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগদান করি। আমার স্ত্রী মিসেস আফরুজা বারীর ছোটভাই ইঞ্জিনিয়ার তৌহিদুল ইসলামকে নিয়ে জিনজিরায় নদীর পাড়ে জায়গা ভাড়া নিয়ে পন্টুন, কাঠের নৌকা বানানো শুরু করেছেন। মৃত্যু বরণকারী সন্তানের নামে কোম্পানির নাম দিলেন আনন্দ বিল্ডার্স। বিলেতে আমার স্ত্রী তার পড়ালেখার পাশাপাশি কাজ করায় কিছু টাকা জমে ছিল, ৩ লক্ষ টাকা দিয়ে মেঘনাঘাটে নদীর পাড়ে ২৭ বিঘা জমি কিনলেন। আনন্দ বিল্ডার্স নিজস্ব জায়গায় মে ১৯৮৩ সালে স্থায়ীভাবে স্থাপিত হ’ল, লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হ’ল। ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রসার হলে আমি ১৯৮৮ BUET ছেড়ে আনন্দতে যোগদান করি।

দৈনিক কালের সমাজ : জাহাজ নির্মাণে/রপ্তানিতে কোন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কি?

আব্দুল্লাহেল বারী : ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশে ইস্পাতের জাহাজ নির্মাণ নিবিড় ভাবে শুরু হয়নি। কাঠের দোতলা লঞ্চ আর sunken ডেক যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলে ছিল। বাংলাদেশে ইস্পাত নির্মিত মালবাহী নৌযান অতি সীমিত আকারেই তৈরী হচ্ছিলো এবং সেগুলি কাঠের নির্মাণ পদ্ধতি অনুসরনে নির্মিত হচ্ছিল। জলযানে ব্যবহৃত ইস্পাতের বস্তু সমূহ প্লেট ইত্যাদি পরিস্কার করা বা রং করার রেওয়াজ তখনো প্রচলিত নয়। আনন্দ বিল্ডার্স লি: দেশে প্রথম আধুনিক পদ্ধতিতে জাহাজ নির্মাণ শুরু করে অর্থাৎ, ব্লাস্টিং, পেইন্টিং, কম্পিউটার এইডেড কাটিং, গ্রাইন্ডিং, ওয়েল্ডিং, ছিম ক্লিনিং, মেরামতের জন্য সহজে খোলা যায় এমন নিয়মে নির্মিত পাইপ লাইন, বায়ু নিরোধি, জল নিরোধি ইঞ্জিন রুম, পানি নিরোধি বাল্কেট, পানি নিরোধি ডেক, জাহাজের স্টাবিলিটি ইত্যাদি অনুসরন ও ক্রমান্বয়ে লোহার জহাজ নির্মাণ পরিচিত করে। উন্নত গুণগতমান, সময়মত সরবরাহ এবং ক্রেতা সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আনন্দ বিল্ডার্স কাজের মুনাফা করে শিপইয়ার্ডের আধুনিকায় করে চলে। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে প্রথম ক্লাস জাহাজ তৈরি করে, ১৯৯৪ সালে এল আর ক্লাসের অধীনে বিআইডিব্লিউটিএ ৬০ টন ভাসমান ক্রেনের পুনঃনির্মাণ সফলতার সঙ্গে শেষ করে। এটি একটি দুরূহ কাজ ছিল। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে আনন্দ বিল্ডার্স প্রথম কাটার সাকশন ড্রেজার নির্মাণ করে। ১৯৯৬ সালে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ঘাট ও জেটিসহ ১৫০টি পন্টুন নির্মাণের চুক্তি পায় এবং সময়মত সফলতার সহিত কার্য সম্পাদন করে। ১৯৯৮ সালে প্রথম শ্রেণী ক্লাস উপকূলীয় জাহাজ নির্মাণ করে। আনন্দ বিল্ডার্স ১৯৯৯ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ড এন্ড স্লিপওয়েজ লিঃ হিসাবে লিমিটেড কোম্পানীতে রূপান্তরিত হয়। আনন্দ শিপইয়ার্ড বাংলাদেশ প্রথম ও একমাত্র যুদ্ধ জাহাজ নির্মাণকারী শিপইয়ার্ড। ২০০৬ সালে কোস্ট গার্ডের জন্য হাই স্পীড বাই-মেটাল জাহাজ তৈরীর মাধ্যমে আনন্দ শিপইয়ার্ড বিশ্বে খ্যাতিমান ইয়ার্ডে পরিনত হয়।

এইভাবে ১৫ বছর বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করার মাধ্যমে ২-১ টি বিদেশি সংস্থা, যেমন, কোরিয়ান, ডেনমার্ক- নোরাড, হল্যান্ডের ওরেট, ইত্যাদির আনন্দ শিপইয়ার্ডে জাহাজ নির্মাণে উৎসাহ প্রকাশ করে। এরই ধারাবাহিকতায় বিদেশি ক্রেতা গণের কারিগরী পরিদর্শক দল আনন্দ শিপইয়ার্ড পরিদর্শনে আসে। তাঁরা বিভিন্ন ক্রটি-বিচ্যুতি, যেমন, শ্রমিকের মাথার হেলম্যাট, পায়ের জুতা, কাজের পরিচ্ছদ না থাকায় সমালোচনা করেন। ১ বছর সময় প্রদান করে তারা পুঃনশ্চ পরির্দশন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং পরির্দশন করেন। পুনরায় পরির্দশক টিম শিপইয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক কর্মচারীর বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা না থাকায় সমালোচনা করেন। শিপইয়ার্ডে লিকুইড গ্যাস ট্যাংক না থাকায়, স্টেশন স্টেশনে গ্যাস সরবরাহের পাইপ লাইন না থাকায়, মাটির উপর এবং শুণ্যে ইলেকট্রিসিটি লাইন নেয়ার সমালোচনা করেন।

অনেক ডিউ ডিলিজেন্সের পরে ২০০৫ সালে বিদেশী অর্ডার যখন পাওয়া গেল তখন দেশে কোন ব্যাংক বিদেশী প্রথম শ্রেনীর ব্যাংকের মাধ্যমে গ্যারান্টি প্রদান করা দুঃসাধ্য বিবেচনা করছিলেন। বেসিক ব্যাংকের এক সময়ের চেয়ারম্যান জনাব কোরেশী বাবস্থা করে দিলেন। আমরা প্রথম জাহাজ, একটা আধুনিক কন্টেইনার জাহাজ বানিয়ে ডেনমার্কে রপ্তানি করলাম।

দৈনিক কালের সমাজ : প্রথম জাহাজ নির্মাণ এবং রপ্তানির অনুভূতি জানতে চাই।

আব্দুল্লাহেল বারী : চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ডেনমার্কের উদেশ্যে রপ্তানিকৃত প্রথম কন্টেইনার জাহাজটি ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে রওনা করে। ঐ দিন আমি এবং আমার স্ত্রী SMM মেলায় জার্মানিতে আনন্দ শিপইয়ার্ডের প্রদর্শনী স্টলে ছিলাম। বিকালে ৩টা অবদি GL মেলায় TV Channel এ প্রচার করেছিল যে, বাংলাদেশ ডেনমার্কে আধুনিক container জাহাজ রপ্তানি করলো, এ বিষয়ে মেলার Central Stand এ আলোচনা হবে, এখ এর Chairman উপস্থিত থাকবেন। মেলার বহুলোক সমবেত হয়েছিল। এখ চেয়ারম্যান বাংলাদেশকে জাহাজ নির্মাণকারী ও রপ্তানিকারক দেশ হিসাব ঘোষণা দেন। মেলা করতালিতে ফেটে পড়ে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিসেস আফরুজা বারী বলেন “ We are very cost-effective, and we have a hard-working, well-trained workforce. এর অংশ বিশেষ সংযুক্ত। আমি আনন্দিত ও গর্বিত বোধ করছিলাম। আমি বলি “intelligent and dedicated workforce ”-

দৈনিক কালের সমাজ : এই যাত্রায় কারও উৎসাহ আপনাকে সাহস যুগিয়েছে?

আব্দুল্লাহেল বারী : আমি এবং আমার স্ত্রী সর্বদা একসঙ্গে কাজ করেছি। আল্লাহ রাহমানুর রাহিম, আমার স্ত্রী উৎসাহ ও সাহস যুগিয়েছেন।

দৈনিক কালের সমাজ : জাহাজ নির্মাণ শিল্প কতটুকু সম্ভাবনাময়?

আব্দুল্লাহেল বারী : অপার সম্ভাবনায় জাহাজ নির্মাণ শিল্প যুগে যুগে দেশে দেশে জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোপান হিসাবে প্রমানিত। আমাদের নদ- নদীর দেশ, দেশের আয়তনের তুলনায় বৃহৎ সমুদ্রাঞ্চল, ৭৫০ মাইল দৈর্ঘ্য উপকূল, আমাদের ভালো আবহাওয়া, দীর্ঘক্ষন সূর্যের আলো প্রাপ্তি, অল্প বয়সী শ্রমিকদল এবং সর্বোপরি এই শিল্প খাতকে শক্তিশালী রপ্তানির উৎস হিসাবে গড়ে তোলার সরকারের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও প্রচেষ্ঠা জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে অতি উজ্জ্বল ভবিষ্যতে অগ্রসরমান করেছে। এই খাতে সহজেই এবং শীঘ্রই শতটি রপ্তানিকারী শিপইয়ার্ড গড়ে উঠতে পারে, ১,০০,০০০ মানুষের প্রত্যক্ষ এবং দশ লক্ষ লোকের পরোক্ষ কর্ম ক্ষেত্র সৃস্টি হতে পারে, দেশ বছরে অনায়াসে ২০০ টি জাহাজ রপ্তানি করে ২ বিলিয়ন মাঃ ডঃ সমপরিমান (২২ হাজার কোটি টাকা) অর্থ আয় করতে পারে। গভীর সমুদ্রে মাছ ধরে সমুদ্রে বাজারজাত প্রক্রিয়াকরন সমাপান্তে সরাসরি রপ্তানি করে বছরে ২ বিলিয়ন মাঃ ডঃ সমপরিমান (২২,০০০ কোটি টাকা) অর্থ আয় করতে পারে। সমুদ্রে রাসায়নিক কারখানা স্থাপন করে জলজ উদ্ভিত থেকে আমাদের দেশের ঔষধ কারখানার জন্য কাঁচামাল সরবরাহ করে ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানীর বৈদেশিক অর্থের সাশ্রয় করতে পারি। জাহাজ নির্মাণ শিল্প সম্ভাবনা অপরিসীম। জাহাজ নির্মাণ খাত দেশের শিল্প উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখে, যেমন, রাসায়নিক উৎপাদন কারখানার জন্য জটিল পাইপ লাইন সরবরাহ করা, ভারী ইস্পাত নির্মিত কাঠামো,sky scrapper wbg© নির্মাণে বা এয়ার ক্রাপ্ট হ্যাংগার বা সুবৃহৎ কারখানা সেড নির্মাণে ইস্পাত নির্মিত অবকাঠামো সরবরাহ করতে পারে। সর্বোপরি প্রত্যেকটি শিপইয়ার্ড প্রশিক্ষন কেন্দ্র এবং এই শিল্প খাত সমাজকে পারদর্শী পরিশ্রমী মানুষ উপহার দেয় যারা প্রায় সব শিল্প খাতে কাজ করতে পারে।

দৈনিক কালের সমাজ : এই শিল্পের ব্যাপারে সরকারের প্রতি আপনার কোন আহ্বান আছে কি?

আব্দুল্লাহেল বারী : জাহাজ শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা-২০২১ সরকার প্রণয়ন করেছে,সরকারের এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সরকার যে এ শিল্প খাতকে অতি গুরুত্বের সহিত দেখছে এটা তারই প্রকাশ। তবে নীতি নির্ভর আইন প্রনীত না হলে নীতির কার্যকারিতা হ্রাস পায়। অতি দ্রুতার সাথে আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। নিসন্দেহ এটি আমাদের সরকারের কাছে চাওয়। রপ্তানিমুখী খাত, আমেরিকার সাব-প্রায়িম বিদ্ধস্ততা, বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা, ইউরোপ অর্থনৈতিক ধ্বস, কোভিট-১৯
এবং সর্বোপরি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন কারনে জাহাজ নির্মাণ শিল্প খাত চলতি মুলধন শুন্য হয়ে পরেছে। সরকার বিষয়টি উপলব্দি করেছে এবং চলতি মুলধন প্রদান করার জন্য ৫,০০০ কোটি টাকা প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বিশেষ তহবিল গঠন করেছে। সরকার করছে সবই, আমরা যারা উদ্যোক্তা, এই ভারী শিল্পে যাদের পদচারনা রয়েছে তাঁরা কিভাবে আজ দ্বারপ্রান্তে আগত সুযোগ সুবিধাদি দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কাজ লাগাবে তার উপর নির্ভরশীল, দেশকে ধনী দেশে উন্নতির সরকারের গৃহিত মহৎ উদ্যোগ সফল হবে।

দৈনিক কালের সমাজ : বাংলাদেশের বেকারত্ব দূরীকরণে জাহাজ শিল্প কেমন ভূমিকা রাখছে?

আব্দুল্লাহেল বারী : বর্তমানে লক্ষাধিক মানুষ এই শিল্প খাতে কাজ করে। পরোক্ষ ও আনুষঙ্গিক কর্ম সংস্থান বিবেচনায় নিলে ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। এই শিল্প খাতের উৎপাদন বিশ্ব বা মানবগোষ্ঠীকে কর্ম সংস্থানের ক্ষেত্রে কত দূর প্রভাবিত করতে পারে বা করছে তাহাই বিচার্য। সমুদ্রে শত শত মানুষ মাছ ধরে, ট্রলার নির্মিত হয় শিপইয়ার্ডে, পোর্টে কাজ করে শত শত লোক, পোর্ট ব্যবহার করে জাহাজ,
কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্য পরিবহন করে জাহাজ, জাহাজে কাজ করে হাজার হাজার মানুষ; জাহাজ নির্মাণ এ সকল কর্মকান্ডের প্রাণ কেন্দ্র। একটা জাহাজ লক্ষ লক্ষ বিভিন্ন দ্রবাদি সংযোজনে তৈয়ার হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ এ সকল দ্রবাদি উৎপাদন করখানায় কাজ করে। জাহাজ নির্মাণ একটি শ্রমঘন শিল্প। পৃথিবীতে ভারী শিল্পের মধ্যে জাহাজ নির্মাণ শিল্পে আনুপাতিক হারে সর্বাধিক মানব শ্রম ব্যবহার হয়।

দৈনিক কালের সমাজ : জাহাজ শিল্পের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের সুনাম বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন কী?

আব্দুল্লাহেল বারী : জাহাজ নির্মাণ ভারী শিল্প। ভারী শিল্পে বাংলাদেশে পদচারনা সীমিত। আমরা যখন ডেনমার্কে আধুনিক উন্নত মানের জাহাজ রপ্তানি করলাম তখন ঊচই “Bangladesh transforms from shit to ship exporter” প্রচার করলো। দেশের ভাবমুর্তি বিশ্বের দরবারে নতুন মাত্রা পেলো। এই খাত নি:সন্দেহে বাংলাদেশকে মর্যাদাপূর্ণ দেশে পরিনত করেছে।

দৈনিক কালের সমাজ : আপনার সামাজিক এবং মানবিক কাজ সম্পর্কে একটু জানতে চাই।

আব্দুল্লাহেল বারী : তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। এগুলি নিতান্তই নিন্মরূপ :
* বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার অভাবী পরিবারের মেয়েদের বিয়ের জন্য সহায়তা প্রদান।
* অটিস্টিক শিশুদের যত্ন নেওয়ার জন্য নিবেদিত সংস্থা এবং কেন্দ্রগুলিকে সহায়তা প্রদান করা।
* অসুস্থ কর্মচারীদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান।
* স্কুল, মাদ্রাসা এবং এতিমখানা কেন্দ্রে সহায়তা করা।
* Sponsoring JOYFUL LIVES FOR ELDERLY PEOPLE.
* অপুষ্টি, পানিবাহিত রোগ এবং পানীয় জল ও খাদ্যের তীব্র সংকটে ভুগছেন এমন বন্যা দুর্গতদের সাহায্য সহযোগিতা প্রদান।
* স্থানীয় এতিমখানা ও রমজানে এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন জামা-জুতা বিতরণ।
* শীতে অসহায় মানুষের মাঝে কম্বল ও গরম কাপড় বিতরণ।
* সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় কবরস্থানের উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণে সহায়তা প্রদান।
* COVID-19 মহামারী চলাকালীন সারা বাংলাদেশে মাস্ক বিতরণ ।
* ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় ঢাকা শহরের দরিদ্র বাসিন্দাদের বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের জন্য অ্যালুমিনিয়াম জল বহনকারী নৌকা তৈরি ও ব্যবহার ।
* টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা যোগদানকারী লোকদের প্রতি বছর পানীয় জল বিতরণ করে।
* স্কুল কলেজে গরীব মেয়েদের ব্যবহারের জন্য বিনামূল্যে স্যানিটারি প্যাড বিতরণ।

দৈনিক কালের সমাজ : আপনার শিক্ষা জীবন এবং কর্ম জীবন সম্পর্কে একটু জানতে চাই।

আব্দুল্লাহেল বারী : বাল্যকাল হতেই একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে আমার সুখ্যাতি ছিল। আমি ট্যালেন্টপুলে প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পায় এবং ১৯৬৭ সনে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ড হতে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৭তম স্থান অধিকার করি। ১৯৬৯ সনে রাজশাহী কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিকে (বিজ্ঞান) সম্মিলিত মেধা তালিকায় ৯বম স্থান অধিকার করি এবং ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশ প্রকৌশল
বিশ্ববিদ্যালয় হতে নৌ-স্থাপত্য ও নৌযান প্রকৌশল বিভাগের প্রথম ব্যাচে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করি। ১৯৭৯ সনে কমনওয়েলথ স্কলারশীপ প্রাপ্ত হয়ে যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৮২ সালে জাহাজ নির্মাণে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করি। কর্মজীবনে আমি ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষে সহকারী নৌ স্থপতি পদে যোগদান করি। ১৯৭৭ সনে নৌ স্থপতি পদে পদোন্নাতি প্রাপ্ত হই। ১৯৭৮ সনে BUET এর কাজের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের জাহাজ জরীপকারক হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করি। কর্তৃপক্ষের ‘মেকানাইজেশন অব কান্ট্রিবোট প্রকল্পের’ মাধ্যমে আমি বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইঞ্জিন চালিত নৌকার প্রচলন করি, যা পরবর্তীতে আমাদের অভ্যন্তরীণ নদী পথে মালামাল পরিবহণে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায়। এর ধারাবাহিকতায় জাহাজ নির্মাণের ডিজাইন, ড্রয়িং এর নৌ স্থাপত্য প্রকৌশল সম্মত অনুমোদ পদ্ধতির সূচনা করি। ১৯৭৬ সন থেকে ১৯৭৯ সময়ে আমি প্রোডাকশন প্লানিং এণ্ড কন্ট্রোল, শিপস ক্লাসিফিকেশন রুলস্ধসঢ়; এবং জাহাজের রেজিস্ট্যান্স-প্রপালশনে যুক্তরাজ্যে এবং নেদাল্যান্ডের Delft University তে বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করি। যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৮২ সনে পিএইচডি অর্জন করে, দেশে ফিরে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ পরিবহণ সংস্থায় প্রধান প্রকৌশলী (নৌ নির্মাণ ও পরিকল্পনা) পদে যোগ দেই। ১৯৮৫ সনে ইটঊঞ এ সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগদান করি। বাংলাদেশে ১৯৮৫ সনে আমি প্রথম মেঘনাঘাটে দেশী ড্রেজার ডিজাইন ও নির্মাণ করি যা ক্রমানয়ে বাংলাদেশে সর্বোত্র ছড়িয়ে পরে ও বাল্কেডের মাধ্যমে বাড়ী বাননো বা শিল্প স্থাপনের জন্য মাটি ভারাটের কাজে ব্যবহার হয় এবং যা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলছে।
দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের করার জন্য ১৯৮৭ সনে আমি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে আনন্দ বিল্ডার্স লিঃ এর দায়িত্ব গ্রহণ করি। আমার লেখা কবিতার বই “আত্ম প্রকাশ” এবং গল্পের বই “সংসার” ২০২২ সালে প্রকাশ পায়।


দৈনিক কালের সমাজ : আপনার জীবনের একটি আনন্দময় এবং দুঃখময় স্মৃতি জানতে চাই।

আব্দুল্লাহেল বারী : আমাদের প্রথম সন্তান আনন্দের (আব্দুল্লাহ আল মোউতি) ১৯৭৮ সালে ৮ ই মে মাসে ইন্তকাল দুঃখময় এবং ২০০৮ সালে ১৩ ঐ সেপ্টেম্বর মাসে “স্টেলা ম্যারিস” রপ্তানি আনন্দময় দিন।

দৈনিক কালের সমাজ : আপনার শৈশব সম্পর্কে একটু জানতে চাই।

আব্দুল্লাহেল বারী : সেই কবেকার কথা, এক থালা ঘিমাখা ভাত, বসে খাও, আর সুযোগ যদি পাও চারপামের মুরগিকে ছিটিয়ে দেও, খাওয়া তাড়াতাড়ি শেষ হবে।বেঁচে গেলে এক বেলা। সবাই ব্যস্ত, ধান আর ধান, বাছুর, বলদ, গাভী, মানুষ আর মানুষ। খড়ি চিরে, ভিজা ধানের বড় কড়াই চুলায় জ্বাল দেয়।। খোলাভরা বিছানো ধানগাছে একপাল গরু ঘুরেঘুরে ধান মাড়াই করে। অনেকদিনের পালা দেওয়া ধানগাছের গাঁদা থেকে কিরকম একটা গন্ধ ছড়ায়। শুকাতে খোলাভরা ধান ছড়ান,শুকনো ধান ঢাকি ঢাকি (ঝাঁকা ভরে ভরে) গোলায় তোলে, সারিবদ্ধ পিঁপড়ার মতো চলে অনেক মানুষ। গুমোট গরম, হটাৎ বৃষ্টি আসে, সবাই আপন পর ভুলে ধান জড়ো করে, বাঁশের বড় ঝাপি দিয়ে ঢেকে দেয়। কখনওবা ক্ষনিকেই বৃষ্টি চলে যায়।মাঠ জুড়ে পল ছড়িয়ে দেয়া, শুকিয়ে পালা করে রাখতে হবে, সারা বছরের গরু বাছুরের খাবার। পাকা কাঁঠাল পেঁড়ে অনেকে মিলে খায়। সারি ধরে মানুষ ঢাকি(ঝাঁক) নিয়ে বসে থাকে ধান নেবার জন্য। তাদের ধান উঠলে ফিরে দেবে। অসম্পূর্ণ দালান ঘরের বারান্দায় একটা বিরাটকায় কলসে মুড়ি চিড়া কিছু একটা রাখা আছে, নারিকেলের মলইয়ে কাঠি লাগানো একটা ঘুঁগনি (হাতা) দিয়ে পাশে রাখা কাঠায় নিয়ে যার ইচ্ছা খেয়ে নাও, কল থেকে পানি খাও, চাই কি হাতমুখ ধুয়ে নাও, কেউ কারো দিকে খেয়াল রাখে না। ঢাকা থেকে বন্ধু বান্ধব নিয়ে আসা ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া বড় ভাইয়েরা খানকা ঘরে বসে তাস খেলছে, তাঁদেরকে নাস্তা, পান সুপারি, হুক্কা, বিড়ি দেয়া সেও যে সে কাজ নয়, এদিক ওদিক হলেই বাঘের গর্জন। লোকও নির্ধারিত করা আছে । শিক্ষিত পরিবার হিসাবে এলাকায় এ বাড়ী পরিচিত । লেখা পড়ার পরিবেশ কোথাও কারো চোখে পড়বে না, দেখবে বড় গৃহস্তের ব্যস্ত বাড়ী । বাড়ীর নিকটের স্কুল বাদ দিয়ে নওদাবগা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাকে ৪র্থ শ্রেনিতে ভর্তি করা হয়েছে । এ সময়টি ছিল আনন্দের, তার অনেক কারনও আছে। তিন চাচাত ভাই একই শ্রেনীতে পড়তাম, এক সাথে স্কুলে যাতায়ত করতাম । দুই কিলোমিটার পথের দূরত্ব ছাড়া যাতায়াতে কোন অসুবিধা ছিল না। হটাৎকোনদিন ফর্সা ধুতি পরা বৃদ্ধ লোক এসে বলত ‘দাদাবাবুকে রাণীমা ডাকছেন’। মাস্টার সাহেব আপত্তি করতেন না। আমি ভীত দ্বিধান্বিত চিত্তে ধীর সংগী হতাম। দেখার সাথে সাথে জাপটে ধরে কোলে নিয়ে দুই হাঁটুর উপর বসাতেন, এ গালে ও গালে চুমু খেতেন। অতি সুশ্রী ২০/২২ বছর বয়েসের কাছেই দাঁড়ান মেয়েটি বলে উঠে, “ওর কাপড় চোপর, হাত পায়ে ময়লা” । উপরের দিকে তাকিয়ে লজ্জিত হয়ে দেখেছিলাম ঘৃনাভরা অপূর্ব সুন্দর দু’টি চোখ। যাঁর কোলে বসাছিলাম তিনি হাঁক ডাক শুরু করলেন, “শিবুর মা, বাতাসা আন, দিইয়ে একটা মিস্টি দিয়ে আনিস”। উপরে তাঁকিয়ে বললেন, ‘তোমার গোলেবুর ছেলে’।স্কুলের পথে মার্বেল খেলা, লাঠিম ঘুরানো, বট গাছের গোঁড়ায় বসে সেখানে পড়ে থাকা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে টানা, আহা কি আনন্দ। রাস্তার পাশে পাড়ার ছেলেদের সাথে ছোটখাট মারপিট নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পড়ালেখা কিছু পারতাম কিনা মনে নেই। পড়ালেখা করতামই না। সারাদিন মার্বেল নিয়েই থাকতাম।
প্রমথ রাতে পা টিপে ঘুমিয়ে দিত, দিন হলেই নাস্তাপানি হ’ক আর নাই হোক এক মগ মার্বেল নিয়ে খেলা শুরু হত, প্রমথের হাত ছিল যেন অর্জনের তীর, লক্ষ্যভেদে স্থির । খেলা চলত আর চলত। হারজিৎ হতো, আবার শুরু হতো। শেষ নাই, কুরুক্ষেত্র। বড় বোন হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেত কুয়োরপাড়ে, হাতমুখ ধোয়া, ঘষা মাজা, কষ্টে আমার চোখে জল আসত। গোসল করিয়ে দিতো। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে চোখে মুখে ভাত গুঁজে বইখাতা বগলে চেপে স্কুলে ছুট। প্রধান শিক্ষক, অংকের মাস্টার, অনেক বিষয়ে ক্লাস নেন, বয়সী, আব্বার বন্ধু ছিলেন, পরে শুনেছি। আব্বা বগুড়া জেলা স্কুলে পড়েছেন, প্রথম বিভাগে লেটারসহ এন্ট্রাস পাস করেন ১৯২০ সালে কলিকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং শিবপুর প্রকৌশল কলেজে পড়েছেন ; বন্ধুত্ব হবার কারণ মাস্টার সাহেব অংকবিশারদ আর আব্বা যাদব পুরস্কার না কি যেন একটা পেয়েছিলেন। আসে পাশের স্কুলের ১০/১২ জন আমরা মাস্টার সাহেবে বাড়ীতে বৃত্তি পরীক্ষার অংক শিখতাম । বৃত্তি পরীক্ষায় স্কুল থেকে শুধু আমারই নাম পাঠান হয়েছে। হেড মাস্টার সাহেব নাম লিখে দিয়েছেন, মোঃ আবদুলাহেল বারী, মোঃ আব্দুল বারীর পরিবর্তে, বড়ভাই জন্ম তারিখ লিখে দিয়েছিলেন, ১লা জানুয়ারী ১৯৫২, শুনেছি প্রায় ৮ মাস বাড়িয়ে। বড়ভাই মো: আমিনুর রহমান ভাল ছেলে, অংকে তুঁখর ছাত্র হিসাবে পরিচিতি ছিলেন। বগুড়া জেলা স্কুলে পড়তেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় তাঁর জন্ম তারিখ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, বয়স ১৬ বছর হয়েছে কি? কোর্টে আব্বাকে এভিডেভিড কওে ছেলের বয়স বলতে হয়েছিল। অবাক কান্ড, আমি একাই বৃত্তি পেলাম। বাড়ীর অতি নিকটে সুখানপুকুর হাই স্কুলে ভর্তি হলাম। আমার পিঠাপিঠী বড় রেজুবু শহরে ইয়াকুবইয়া স্কুলে পড়তেন, তিনিও এসে ঐ স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ক্লাসে আমিই একমাত্র বৃত্তিধারী। জীবনটাই যেন কেমন পালটে গেল। লেখাপড়া করতে থাকলাম। ক্লাসে কত ছাত্রী! স্যারের কোন প্রশ্নের যদি উত্তর না দিতে পারি! মুখ টিপে হাসবে সব সুন্দর সুন্দর মেয়েরা। ভাগ্য ভাল রেজুবু অন্য সেকশনে পড়তেন। বিভ্রাট ঘটল, পরীক্ষায় প্রথম হতে পারিনি, হয়েছি সপ্তম। চোখের জলে বুকের জামা ভিজে গেল। দিনের শেষভাগে উর্দু ক্লাস নিতে এসে মৌলভী স্যার বলেন, “আব্দুল বারী উর্দুতে ফেল করছিস। মোছলেমের চেয়ে তোর নম্বর ১১০ বেশী”। হা করে তাকিয়ে থাকলাম, বুঝলাম না কিছুই। “পাক ছার জামিন সাদ বাদ টাও লিখতে পারলি না! গর্দভ !” মার্কসীট নিয়ে লজ্জায় বাড়ী ফিরছি। দু-একজন মেয়ে এসে কতকটা কানে কানে বলল, মন খারাপ করছ কেন, তুমিই তো ফাস্ট হয়েছ। বুকটা প্রসারিত হয়ে যেন উত্তর দক্ষিন মেরু স্পর্শ করলো। রহমান ভাই মার্কসীট দেখে বললেন, “খুব ভাল ফল করেছিস। এক বিষয়ে ফেল করেছিস। সেটা অবশ্য খুব খারাপ”। রহমান ভাই ছাড়া আর কারো আমার পড়া লেখা নিয়ে খুব মাথাব্যথা ছিলনা।

দৈনিক কালের সমাজ : শিক্ষার্থী এবং যুবকদের প্রতি আপনার কোন পরামর্শ আছে?

আব্দুল্লাহেল বারী : শিক্ষার্থী বলতে আমি ধরে নিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র সমাজ, আর যুবক বলতে উভয় লিঙ্গের ২০-৩০ বছরের সকল মানুষকে। একজন শিক্ষার্থী পিতা-মাতার ঘাঁড়ে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সময়, বছর চারেক অতিবাহিত করে। বিশ্ববিদ্যালয় হতে এক টুকরো কাগজ নিয়ে বেরিয়ে নিজের, পরিবারের, সমাজের, দেশের ও মানবগোষ্ঠীর মঙ্গলকরণের দায়িত্ব ভার ঘাঁড়ে গ্রহন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে জ্ঞানের জাহাজ
বানানো হয় না, বরং সে জ্ঞান সমুদ্রে প্রবেশে করছে তারই একটি আপছা ধারনা দেওয়া হয়। একজন শিক্ষক ছাত্রের মনন ও চিন্তাশক্তির উন্মোচন করে। ক্ষুধা যেমন সর্বোত্তম সালাদ জ্ঞ্যানের পিপাসা ওমনী জ্ঞ্যান অর্জনের মূল চাবীকাটি। একজন শিক্ষক একজন শিক্ষার্থীর মাঝে জ্ঞ্যানে ঐ ক্ষুধা-পিপাসা সৃস্টি করে। শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ পায় তারা ভাগ্যবান এবং তারা বিশেষ ব্যক্তিত্ব। বিশ্ববিদালয়ে একজন শিক্ষার্থীর মনন ও মানসিকতার যে উন্মেষ ঘটে উহাই তাহার শক্তি ও পাথেয়। যেগুরু দায়িত্ব শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন শেষে তার উপর নেস্ত হয় তাহা প্রতিপালনে তাকে হতে হয় উদীয়মান সূর্যের মত উজ্জ্বল, প্রখর ও অস্তমান সূর্যের মত নমনীয় ও রক্তিম। কার্যক্ষেত্রে তার বিচ্ছুরিত আভা চর্তুরপাশকে আলোকিত করবে এবং পরিচিতের মাঝে একটি আশার সঞ্চার করবে ইহাই কাম্য।

জীবন গড়ার, সেবা প্রদানের, ভোগের, অপভোগের যুবকালটাই সময়। কাঁদা মাটি ছেনে মুর্তি বানালে তার রূপ কি হবে, সেটা নির্মাতার উপর। জীবনের নির্মাতা একজন যুবতী/যুবক সে নিজেই। মুর্তি শুকানোর উপরেই তার স্থায়িত্ব। অতএব, জীবন কি রূপে বিকশিত হবে এবং এর গ্রহন ও প্রদানের ক্ষমতাই বা কি হবে সেটার অর্জন এই সময়েই। সংঘাতময় জীবনের যতখানি তাপ যে গ্রহন করতে চায় এবং গ্রহন করতে পারে, তাই তাকে সাফল্য মন্ডিত করে। জন্মে ভেদাভেদ বা পার্থক্য থাকে, যেমন, ধর্ম, সংস্কৃতি, স্বচ্ছলতা, যা জীবনকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে, এই কথাও ঠিক যে, খাদ্যের উপর স্বাস্থ্য, বুদ্ধিমত্তা ও পরিবেশর উপর প্রতিভা বিকাশ নির্ভরশীল। কিন্তু ২০ বছর বয়সে এসে এর সবকিছুই ধুয়ে মুছে যায়। তাই নিজেকে, পরিবার, সমাজ, দেশ, জাতি ও বিশ্বকে একজন মানুষ কি দেবে, কি রেখে যাবে পরবরতী প্রজন্মের জন্য তা নির্দ্ধারন করবে যুবাকালে; এটিই আমি যুবসমাজকে স্বরণ করে দিতে চাই।

দৈনিক কালের সমাজ : দৈনিক কালের সমাজ পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।

আব্দুল্লাহেল বারী : আপনাকে ও দৈনিক কালের সমাজ পরিবারের সব সদস্যকেও আমি অপরিসীম ধন্যবাদ ও মোবারকবাদ জানাচ্ছি।

 

কালের সমাজ//এ.জে

Side banner